প্রায় দু’মাস ধরে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতির প্রতিটি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পোত্পাদন, আমদানি-রফতানি সবকিছুতেই স্থবিরতা প্রকট হয়ে উঠেছে। গোটা অর্থনীতিতে চলছে বিনিয়োগ মন্দা। এতে থমকে দাঁড়িয়েছে ব্যাংকের অর্থায়ন। পর্যাপ্ত তারল্য থাকার পরও ঋণের চাহিদা নেই। আবার ব্যবসা-বাণিজ্যের বিরূপ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকৃত অর্থের বকেয়া যথাসময়ে পরিশোধ করা হচ্ছে না। বিরাজমান অস্থিরতায় দেশের ব্যাংকিং খাত বড় ধাক্কা খেয়েছে বলা চলে। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিদ্যমান রাজনৈতিক সহিংসতা, হরতাল-অবরোধে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়ায় উদ্যোক্তাদের পুঁজি যেমন আটকে যাচ্ছে, তেমনি কমে যাচ্ছে অর্থের প্রবাহ। এ অবস্থায় আর্থিক সংকটে পড়ে অনেকেই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারাতে পারেন।
বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতায় বিভিন্ন পণ্যের উত্পাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার জোরালো আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে পণ্যসামগ্রী আমদানির ক্ষেত্রে আগামী দিনগুলোয় বিভিন্ন দেশকে বাড়তি অর্থ গুনতে হতে পারে। এ কারণে আমাদের রফতানি বাণিজ্যে ভাটা পড়ার আশঙ্কা তীব্র হয়ে উঠেছে এখনই। চলমান হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে ব্যাংকগুলোয় আমদানি-রফতানি ব্যবসায় এক ধরনের অধোগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট এলসি খোলার পরিমাণ অনেক কমেছে গত দু’মাসে। বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে সাধারণত ব্যাংকগুলো এক্সচেঞ্জ কমিশন হিসেবে বিপুল পরিমাণ আয় করে থাকে, যা বর্তমানে হ্রাস পেয়েছে। হরতাল-অবরোধে নিরাপত্তার অভাবে গ্রাহকের উপস্থিতি তেমন বাড়ছে না ঢাকার বাইরে মফস্বল শহরগুলোয়। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে ব্যাংকে আসছেন না গ্রাহকরা। এক ধরনের শঙ্কা-ভয়ের পরিবেশে চলছে ব্যাংকের কার্যক্রম। এছাড়া ব্যাংকের শাখা পর্যায়ে নগদ টাকা সরবরাহ প্রক্রিয়ায়ও বিঘ্ন ঘটছে। এ অবস্থায় কাঙ্ক্ষিত গ্রাহক সেবা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে অনেক ব্যাংক। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে মানুষের সঞ্চয়ে। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা জেঁকে বসায় ব্যবসায়ীদের খেয়ে-পরে বাঁচাটাই যেন কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা সঞ্চয়ের কথা ভাবতে পারছেন না। বরং লোকসান গুনছেন ব্যবসায়। তারা যথাসময়ে ব্যাংকে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন। বিনিয়োগের গতি থেমে গেছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকগুলোর আমানত ও ঋণ স্থিতি কমে গেছে; যা ব্যাংকারদের স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সাধারণত আগের তুলনায় কোনো সময়ে ঋণ ও আমানতের স্থিতি কমতে দেখা যায় না। চলমান রাজনৈতিক-সামাজিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অনেকে ব্যাংকে টাকা জমা করতে পারছেন না। এছাড়া ব্যাংকগুলোর তুলনায় সঞ্চয়পত্রের সুদ হার বেশি থাকায় কেউ কেউ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে হয়তো সেখানে বিনিয়োগ করছেন। এতে ব্যাংকগুলোর আমানত কমছে। অন্যদিকে এখন নতুন ঋণ বিতরণ খুব কম হচ্ছে। আবার অনেক গ্রাহক অনুমোদন হওয়া ঋণসীমা অনুযায়ী বাড়তি অর্থ নিচ্ছেন না। এভাবে পরিস্থিতি যদি আরো দীর্ঘায়িত হয় তাহলে ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়িক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব হয়ে উঠবে, বলা যায়। হরতাল-অবরোধে দূরদূরান্তের শাখাগুলোয় ঠিকমতো নগদ টাকা পৌঁছানো যাচ্ছে না। এটিএম বুথগুলোয়ও অনেক সময় অর্থ সংকট দেখা দিচ্ছে। হরতালের কারণে সব এটিএম বুথে টাকা ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। হরতাল-অবরোধে নগদ টাকা পরিবহনের ক্ষেত্রে কোনো বীমা কাভারেজ পাওয়া যায় না ফলে পুলিশ পাহারায় নগদ টাকা পরিবহন করতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকের রেমিট্যান্স খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
ওদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার দোহাই দিয়ে অনেক ব্যবসায়ীই ফায়দা হাসিল করতে ব্যাংকগুলোয় ঘোরাঘুরি শুরু করেছেন। যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তার চেয়ে ক্ষতি বেশি দেখিয়ে তারা ব্যাংক থেকে নানা সুযোগ গ্রহণের ফন্দিফিকির করছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার দোহাই দিয়ে অনেক সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী বড় খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের জন্য আবেদন করছেন। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি সিদ্ধান্তে ব্যাংকগুলোকে কিছু ছাড় দিতে হয়। আর এটি করা হলে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক কারণে নেয়া হয়ে থাকে, যার খেসারত দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর ভিত্তি ও কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে সাধারণত। এমনিতেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নানা সমস্যা-সংকট মোকাবেলা করে এগিয়ে চলেছে। প্রতিদিন অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন ব্যাংকাররা। প্রতিটি ব্যাংক সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও প্রত্যাশিত ব্যবসায়িক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ব্যাপারে আস্থাশীল হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে প্রতিটি ব্যাংক নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করে বিদ্যমান প্রতিকূলতা মোকাবেলার চেষ্টা করছে। যদিও এক্ষেত্রে সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ব্যাংকগুলো তাদের ব্যবসায়িক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই। ব্যাংক হলো একটি দেশের অর্থনীতির মূল প্রাণকেন্দ্র। ব্যাংককে ঘিরে দেশের যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। আমদানি-রফতানি, শিল্পোত্পাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাংক ছাড়া সম্পাদন করা সম্ভব নয়। যেখানে ক্রমাগত রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি, অনিশ্চিত পরিবেশ অর্থনীতিতে স্থবিরতা এনে দিয়েছে, সেখানে ব্যাংক স্রোতের প্রতিকূলে নিজেদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে কীভাবে এগিয়ে যাবে— সেটাই হলো প্রশ্ন। তার পরও আমাদের প্রত্যাশা, বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট দূর হয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে, সুস্থ-সুন্দর ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। গত দু’মাসে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতায় সৃষ্ট ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সবাইকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে— এটা সবাইকে বিবেচনায় রাখতে হবে।